প্রবন্ধ
‘‘বিদআত’’ কি ও কেন? বিদআতের ভয়াবহতা
দুটি জিনিস যা মানুষের ঈমান ও আমলকে ধ্বংস করে দেয়।
এক. শিরক যা ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়।
দুই. বিদআত যা আমলকে ধ্বংস করে দেয়।
এই প্রবন্ধটি আমল ধ্বংসকারী বিদআত প্রসঙ্গে।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) এর সতর্কবাণী বক্তব্য। তিনি বলেন:
"যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে এমন একটি নতুন কাজ চালু করে, যা সে ভালো মনে করে, সে যেন এ দাবিই করল যে, মুহাম্মদ ﷺ আমানতের খিয়ানত করেছেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, 'আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম' (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৩)। সুতরাং যা সে দিন দ্বীন ছিল না, তা আজও দ্বীন হতে পারে না।" আল ইতিসাম (ইমাম শাতিবী রহ.) ১/৪৯
‘‘বিদআত’’ সাধারণ অর্থে যেকোনো নতুন বা নব আবিষ্কৃত বিষয়কে বোঝানো হয়।
যাদের কাছে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান রয়েছে, তারা কখনও নব আবিষ্কৃত যা কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের বাইরে তা সওয়াবের আশায় বা জরুরি মনে করে করতে পারে না।
বস্তুত, শেষ নবীর দ্বীন ও শরীয়ত তিনার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণ করে দিয়েছেন এবং মাপকাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছেন কোনটি করা যাবে আর কোনটি যাবে না।
এজন্য, এর বাইরে গিয়ে যারা শেষ নবীর দ্বীনের নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করবে না, তারাই পদে পদে গোমরাহির দূর্বাস ছড়িয়ে সমাজ ও শরীয়তকে ধ্বংস করবে। এটাই স্বাভাবিক বিষয়।’’
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَاَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَرَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا ؕ
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। সূরা মায়েদা আয়াত ৩
তাফসীর:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ এ আয়াত কোরআনের শেষ দিককার আয়াত। এরপর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। বলা হয় যে, শুধু উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনমূলক কয়েকখানি আয়াত এর পর নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ্ (সা) মাত্র একাশি দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। কেননা, দশম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ তারিখে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং একাদশ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে হযরত রাসূলে করিম (সা) ওফাত পান ।
এ আয়াত যেমন বিশেষ তাৎপর্য ও গুরুত্ব সহকারে অবতীর্ণ হয়েছে, তেমনি এর বিষয়বস্তুও ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের জন্য বিরাট সুসংবাদ, অনন্য পুরস্কার ও স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর বহন করে। এর সারমর্ম এই যে, পৃথিবীতে মানব জাতিকে সত্য দীন ও আল্লাহর নিয়ামতের চূড়ান্ত মাপকাঠি প্রদানের যে ওয়াদা ছিল, আজ তা ষোল কলায় পূর্ণ করে দেওয়া হলো। হযরত আদম (আ)-এর আমল থেকে যে সত্য ধর্ম ও আল্লাহর নিয়ামতের অবতরণ ও প্রচলন আরম্ভ করা হয়েছিল এবং প্রত্যেক যুগ ও প্রত্যেক ভূখণ্ডের অবস্থানুযায়ী এ নিয়ামত থেকে আদম সন্তানদের অংশ দেওয়া হচ্ছিল আজ যেন সেই ধর্ম ও নিয়ামত পরিপূর্ণ আকারে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা) ও তাঁর উম্মতকে প্রদান করা হলো।
এতে যেমন সব নবী ও রাসূলের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সৌভাগ্য ও স্বাতন্ত্র্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি সাথে সাথে সব উম্মতের বিপরীতে তাঁর উম্মতেরও বিশেষ স্বাতন্ত্র্যমূলক মর্যাদার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
এ কারণেই একবার কতিপয় ইহুদী আলিম হযরত ফারুক (রা)-এর কাছে এসে বললেনঃ আপনাদের কোরআনে এমন একটি আয়াত আছে, যা ইহুদীদের প্রতি অবতীর্ণ হলে তারা অবতরণের দিনটিকে ঈদ উৎসব হিসাবে উদযাপন করত। ফারুকে আযম প্রশ্ন করলেনঃ আপনাদের ইঙ্গিত কোন্ আয়াতটির প্রতি ? তারা উত্তরে الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ ا আয়াতটি পাঠ করলেন।
হযরত ফারুকে আযম (রা) বললেনঃ হ্যাঁ আমরা জানি এ আয়াতটি কোন্ জায়গায়, কোন্ দিনে অবতীর্ণ হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, এ দিনটি আমাদের জন্য একসাথে দু’টি ঈদের দিন। একটি আরাফা ও অপরটি জুমআ ।
ঈদ ও উৎসবপর্ব উদ্যাপনের ইসলামী মূলনীতিঃ ফারুকে আযম রাযিয়াল্লাহু আনহুর এ উত্তরে একটি ইসলামী মূলনীতির প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে। এ মূলনীতিটি বিশ্বের সব জাতি ও ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলামেরই স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। বিশ্বের প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীই নিজ নিজ অবস্থা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর স্মৃতিবার্ষিকী উদযাপন করে। এসব দিন তাদের কাছে ঈদ অথবা উৎসবপর্বের মর্যাদা সহকারে পালিত হয়ে থাকে।
কোথাও কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্ম অথবা মৃত্যু অথবা সিংহাসনারোহণ দিবস পালন করা হয় এবং কোথাও কোন বিশেষ দেশ অথবা শহর বিজয় অথবা কোন মহান ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি দিবস পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য বিশেষ ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ইসলামে ব্যক্তিপূজার স্থান নেই। ইসলাম মূর্খতা যুগের যাবতীয় রীতিপ্রথা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মৃতি পরিত্যাগ করে মূলনীতি ও উদ্দেশ্যের স্মৃতি প্রতিষ্ঠা করার নীতি অবলম্বন করেছে।
হযরত ইবরাহীম (আ)-কে ‘খলীলুল্লাহ্’ উপাধি দান করা হয়েছে। কোরআন পাক— وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ বলে তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষা ও তাতে তাঁর সাফল্যের প্রশংসা করেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁর জন্ম অথবা মৃত্যু দিবস উদ্যাপন করা হয়নি এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ) ও তদীয় জননীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস অথবা কোন স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়নি।
হ্যাঁ, তাঁর কাজকর্মের মধ্যে যেসব বিষয় ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, সেগুলোর শুধু স্মৃতিই সংরক্ষিত রাখা হয়নি, বরং সেগুলোকে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য ধর্মের অঙ্গ তথা ফরয-ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। কুরবানী, খতনা, সাফা ও মারওয়ার মধ্যস্থলে দৌড়াদৌড়ি, মিনার তিন জায়গায় কঙ্কর নিক্ষেপ--এগুলো সবই তাঁদের ক্রিয়াকর্মের স্মৃতি যা তাঁর আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে স্বীয় নফসের কামনা-বাসনা ও স্বভাবজাত দাবি পিষ্ট করে সম্পাদন করেছিলেন। এসব ক্রিয়াকর্ম প্রতি যুগের মানুষকে আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য প্রিয়তম বস্তুকে উৎসর্গ করে দেওয়ার শিক্ষা দেয়।
এমনিভাবে ইসলামের যত বড় ব্যক্তিই হোক না কেন তাঁর জন্মমৃত্যু অথবা ব্যক্তিগত কোন সাফল্যের স্মৃতিতে দিবস পালন করার পরিবর্তে তাঁর ক্রিয়াকর্মের দিবস পালন করা হয়েছে। তাও আবার কোন বিশেষ ইবাদতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন শবে-বরাত, রমযানুল মুবারক, শবে কদর, আরাফা দিবস, আশুরা দিবস ইত্যাদি। ঈদ মাত্র দুইটি--তাও খাঁটি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচলিত করা হয়েছে। প্রথম ঈদ পবিত্র রমযানের শেষে এবং হজ্জের মাসগুলোর প্রারম্ভে এবং দ্বিতীয় ঈদ পবিত্র হজ্জব্রত সমাপনান্তে রাখা হয়েছে।
মোটকথা, হযরত ফারুকে আযম (রা)-এর উপরোক্ত উত্তর থেকে বোঝা যায় যে, ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ন্যায় আমাদের ঈদ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর অনুগামী নয় যে, যেদিনই কোন বিশেষ ঘটনা সংঘটিত হবে, সেদিনকেই আমরা ঈদ দিবস হিসাবে উদ্যাপন করব। প্রাচীন জাহিলিয়াতের যুগে এ প্রথাই প্রচলিত ছিল। আজকালকার আধুনিক জাহিলিয়াতও এ প্রথাটিকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি অন্যান্য জাতির অনুকরণে মুসলমানরাও এতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে।
খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ)-এর জন্মদিবসে ‘ঈদে মীলাদ’ উদযাপন করে। তাদের দেখে কিছু সংখ্যক মুসলমান রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর জন্মদিবসে ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামে একটি নতুন ঈদ উদ্ভাবন করেছে। এ দিবসে বাজারে মিছিল বের করা, তাতে বাজে ও অশালীন কর্মকাণ্ড করা এবং রাতে আলোকসজ্জা করাকে তারা ইবাদত মনে করে থাকে। অথচ সাহাবী, তাবেয়ী ও পূর্ববর্তী মনীষীদের কাজেকর্মে এর কোন মূল খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রকৃত সত্য এই যে, যেসব জাতি প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ও বিস্ময়কর কীর্তির দিক দিয়ে কাঙাল, তাদের মধ্যে এসব দিবস পালনের রীতি প্রচলিত হতে পারে। সবেধন নীলমণির মত তাদের দু’চারটি ব্যক্তিত্ব এবং তাদের বিশেষ কীর্তিকেই স্মৃতিদিবস হিসাবে পালন করাকে তারা জাতীয় গৌরব বলে মনে করে।
ইসলামে এরূপ দিবস পালনের প্রথা চালু হলে এক লক্ষ্য চব্বিশ হাজারেরও অধিক পয়গম্বর রয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই শুধু জন্ম নয় বিস্ময়কর কীর্তিসমূহেরও দীর্ঘ তালিকা রয়েছে এসবেরও দিবস পালন করা উচিত। পয়গম্বরদের পর শেষ নবী (সা)-এর পবিত্র জীবনালেখ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি দিনই অক্ষয় কীর্তিতে ভাস্বর হওয়ার কারণে তা পালন করা দরকার। শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত যেসব প্রতিভা ও কীর্তির কারণে তিনি সমগ্র আরবে ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন, সেগুলো কি স্মৃতি উদযাপনের যোগ্য নয় ? এরপর রয়েছে কোরআন অবতরণ, হিজরত, বদর যুদ্ধ, ওহুদ, খন্দক, মক্কা বিজয়, হুনায়ন, তাবুক ও রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অন্যান্য যুদ্ধ। এগুলোর মধ্যে একটিও এমন নয় যে, তার স্মৃতি উদযাপন না করলে চলে। এমনিভাবে তাঁর হাজার হাজার মো’জিযাও স্মৃতি উদযাপনের দাবি রাখে। সত্য বলতে কি, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে হযরত (সা)-এর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর পবিত্র জীবনের প্রত্যেক দিন নয়— প্রত্যেক মুহূর্তই স্মৃতি উদযাপনের যোগ্যতা রাখে।
হযরত (সা)-এর পর তাঁর প্রায় দেড় লক্ষ সাহাবী রয়েছেন। এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর অনুপম জীবনযাত্রার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাঁদের স্মৃতি উদযাপন না করলে তা অবিচার হবে না কি? একবার এ প্রথা চালু হয়ে পড়লে সাহাবায়ে কিরাম মুসলিম মনীষীবৃন্দ, আল্লাহর ওলীগণ, ওলামা ও মাশায়েখ — যাঁদের সংখ্যা কয়েক কোটি হবে, স্মৃতি উদযাপনের তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া অবিচার ও অকৃতজ্ঞতা হবে না কি ? পক্ষান্তরে যদি স্থিরীকৃত হয় যে, সবারই স্মৃতি দিবস উদযাপন করা হবে, তবে সারা বছরের একটি দিনও স্মৃতি উদযাপন থেকে মুক্ত থাকবে না। বরং প্রতিদিনের প্রতি ঘন্টায় কয়েকটি স্মৃতি ও কয়েকটি ঈদ উদযাপন করতে হবে।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও সাহাবায়ে কিরাম এ প্রথাকে জাহিলিয়াতের প্রথা আখ্যা দিয়ে বর্জন করেছেন। হযরত ফারুকে আযম (রা)-এর উক্তিতে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এবার আলোচ্য আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য শুনুনঃ এতে আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁর উম্মতকে তিনটি বিশেষ পুরস্কার প্রদানের সুসংবাদ দিয়েছেনঃ এক. দীনের পূর্ণতা, দুই. নিয়ামতের সম্পূর্ণতা এবং তিন. ইসলামী শরীয়ত নির্বাচন।
দীনের পূর্ণতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কোরআনের ভাষ্যকার হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ বলেনঃ আজ সত্য দীনের যাবতীয় ফরয-সীমা, বিধি-বিধান ও রীতি-নীতি পূর্ণ করে দেওয়া হলো। এখন এতে কোনরূপ পরিবর্ধনের আবশ্যকতা এবং হ্রাস করার সম্ভাবনা বাকি নেই। (রূহুল মা’আনী) এ কারণেই এ আয়াত অবতরণের পর কোন নতুন বিধান অবতীর্ণ হয়নি। যে কয়েকখানি আয়াত এরপর অবতীর্ণ হয়েছে, তা হয় উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনের বিষয়বস্তু সম্বলিত, না হয় পূর্ববর্ণিত বিধি-বিধানের তাকীদ সম্বলিত।
তবে ইজতিহাদের মূলনীতি অনুসরণ করে মুজতাহিদ ইমামরা যদি নতুন নতুন ঘটনা ও অবস্থা সম্পর্কে বিধি-বিধান প্রকাশ করেন, তবে তা উপরোক্ত বর্ণনার পরিপন্থী নয়। কেননা কোরআন পাক যেমন বিধি-বিধানের সীমা, ফরয ইত্যাদি বর্ণনা করেছে, তেমনি ইজতিহাদের মূলনীতির ভিত্তিতে কিয়ামত পর্যন্ত যেসব বিধি-বিধান প্রকাশ করা হবে, তা একদিক দিয়ে কোরআনেরই বর্ণিত বিধি-বিধান। কেননা, এগুলো কোরআন বর্ণিত মূলনীতির অধীন।
সারকথা দীনের পূর্ণতার অর্থ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের তফসীর অনুযায়ী এই যে, ধর্মের যাবতীয় বিধি-বিধানকে পূর্ণাঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এতে কোনরূপ পরিবর্ধনের আবশ্যকতা নেই এবং রহিত হয়ে কম হওয়ারও আশংকা নেই। কেননা, এর পরেই রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ওফাতের সাথে সাথে ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর ওহী ছাড়া কুরআনের কোন নির্দেশ রহিত হতে পারে না। তবে ইজতিহাদের মূলনীতির অধীনে মুজতাহিদ ইমামদের পক্ষ থেকে যে বাহ্যিক পরিবর্ধন হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে পরিবর্ধন নয়; বরং কুরআনী বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা মাত্র। (তাফসীরে মাআ’রেফুল কুরআন, সূরা মায়েদা ৩নং আয়াত দ্র.)
বিদআতের সংজ্ঞা:
শাব্দিক অর্থে বিদআত হলো, প্রতিটি নতুন জিনিস। চাই তা ইবাদত সম্পর্কিত হোক বা সাধারণ অভ্যাসগত বিষয় হোক।
শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত হলো, ইবাদতের এমন সব নতুন পদ্ধতি, যা বেশি সওয়াব লাভের নিয়তে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও খুলাফায়ে রাশেদীন (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর পর উদ্ভাবন করা হয়েছে। অথচ নবী কারীম ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মুবারক যুগে এর ইচ্ছা ও কারণ থাকা সত্ত্বেও তা কথায়, কাজে, স্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিতেও প্রমাণিত নয়।
বিদআতের মূল ভাষাগত অর্থের ভিত্তিতে ওলামায়ে কেরাম এটিকে এমন প্রত্যেক নতুন কাজ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা নবী করিম ﷺ এর যুগে ছিল না এবং কুরআন ও হাদীসে তার কোনো উল্লেখ নেই। এরপর তারা দেখলেন, অনেক এমন বিষয় আছে যা নবীজির যুগে ছিল না এবং কুরআন-হাদীসেও নেই, কিন্তু তা দীন ও শরীয়তের প্রয়োজনে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং উম্মতের উলামা ও ফুকাহাদের কেউও এগুলোকে বিদআত বা হারাম বলেননি, বরং তা দীনী খিদমত এবং সওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ:
১. কুরআন মজীদের হরকাত (যেমন: যবর, যের, পেশ) যুক্ত করা।
২. কুরআনের শব্দ বিচ্ছেদ এবং বিরাম চিহ্ন নির্ধারণ করা যাতে সাধারণ মানুষও কুরআন শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারে।
৩. হাদীস এবং ফিকহের সংকলন, বিশ্লেষণ, বিভিন্ন ভাষায় ইসলামী বই রচনা ও প্রকাশনা।
৪. মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার।
এগুলো স্পষ্টতই নবী করিম ﷺ-এর যুগে ছিল না, এবং কুরআন-হাদীসেও তার উল্লেখ নেই। তাহলে যদি বিদআতের প্রথমোক্ত ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, তবে এসব কিছুই বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা, অথচ তা স্পষ্টতই ভুল এবং বাস্তবতার বিপরীত।
এই জটিলতা দূর করার জন্য উলামা ও হাদীস ব্যাখ্যাকারীরা বলেন যে,
বিদআত দুই প্রকার:
(১) বিদআতে হাসানা : যা শরিয়তের সাথে বিরোধপূর্ণ নয় বরং তার উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক। এটি কখনও ওয়াজিব, কখনও মুস্তাহাব, আবার কখনও মুবাহ (যায়েয) হয়।
যেমন: কুরআনে হরকাত সংযোজন, ফিকহ ও হাদীস সংকলন, ইসলাম প্রচারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দীনী শিক্ষার প্রসারে মাদরাসা স্থাপন ইত্যাদি।
(২) বিদআতে সাইয়্যাহ : যা কুরআন, হাদীস এবং শরীয়তের মৌলিক নীতিমালার বিরুদ্ধে যায়, এটাই গোমরাহি এবং নবীজি ﷺ এর “وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ” হাদীস এর প্রযোজ্য।
বিস্তারিত:
বিদআতে হাসানা :
বিদআতে হাসানা এমন নতুন কাজ, যা শরীয়তের মূলনীতির বিরোধী নয় এবং তা দ্বীনের সংরক্ষণ ও শক্তিশালীকরণের জন্য করা হয়। এটি "বিদআত হাসানা" নামে পরিচিত, যা নিন্দনীয় নয়। যেমন: রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর যুগে মাদ্রাসা ভবনের আকারে ছিল না, শুধু একটি চত্বর ছিল। এখন ভবন ও কক্ষবিশিষ্ট মাদ্রাসা একটি নতুন বিষয়, তবে এটি উত্তম কাজ, কারণ এটি আসল উদ্দেশ্য দ্বীনী শিক্ষা অর্জন, সংরক্ষণ ও প্রচার—কেই সহজ করে।
অনুরূপভাবে, কুরআনে ইরাব (যতিচিহ্ন) ও ওয়াকফ-ওয়াসল ইত্যাদি চিহ্ন সংযোজন করা, হাদিস ও ফিকহ সংকলন করা, প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন ভাষায় দ্বীনী বই রচনা ও প্রকাশ করা এবং মাদ্রাসায় সিলেবাস প্রণয়ন ইত্যাদি এগুলো সবই "বিদআত হাসানা"-এর অন্তর্ভুক্ত।
বিদআতে সাইয়্যাহ:
বিদআতে সাইয়্যাহ হলো এমন সব কাজ, যার ভিত্তি কুরআন-সুন্নাহতে নেই এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ, সাহাবায়ে কেরাম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) ও তাবেইনদের যুগে তা প্রচলিত ছিল না, যদিও তার প্রয়োজন বা ইচ্ছা থাকতে পারত। এগুলো শরীয়তের কোনো দলিল (কথা, কাজ, ইশারা বা স্পষ্ট অনুমতি) দ্বারা সমর্থিত নয়, অথচ লোকেরা তা দ্বীন ও সওয়াবের কাজ মনে করে পালন করে। যেমন: কবরে আজান দেওয়া ইত্যাদি।
বি.দ্র:
শরয়ী পরিভাষায় "বিদআত" বলতে শুধু "বিদআত সাইয়্যাহ"-ই বোঝায়। আর এটাই সেই বিদআত, যার নিন্দা হাদিসে এসেছে এবং একে দ্বীনের মধ্যে নিজ থেকে সংযোজন ও বড় গুনাহ বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে, "বিদআত হাসানা"-কে শুধু ভাষাগত অর্থে "বিদআত" বলা হয়, বাস্তবে এটি শরয়ী বিদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (কাশশাফুল ইসতিলাহাতিল ফুনুনি ওয়াল উলুম ১/৩১৩, মাকতাবা লেবানন)
কিন্তু অনেক গবেষক উলামাগণ বিদআতের দুই প্রকার মানতে নারাজ।
তাঁদের বক্তব্য হলো, "বিদআত" একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিভাষা। এর অর্থ হচ্ছে, এমন কোনো কাজ যা দ্বীনের রঙ দিয়ে ধর্মের অংশ মনে করে করা হয় অথচ কুরআন, হাদীস, ইজমা বা শরয়ী কিয়াসে তার কোনো ভিত্তি নেই।
এই দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী:
যেসব আধুনিক জিনিস (যেমন: ট্রেন, গাড়ি, মোবাইল, ছাপাখানা, বই ছাপানো) দ্বীনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোকে কেউ ইবাদাত বা সওয়াবের কাজ মনে করে না সেগুলো বিদআতের আওতায় পড়ে না। কিন্তু, এমন কোনো কাজ যা ইবাদত বা সওয়াব মনে করে করা হয় অথচ শরিয়তে তার ভিত্তি নেই এটাই প্রকৃত বিদআত।
যেমন: মৃত্যু পরবর্তী তৃতীয়, দশম, চল্লিশতম দিবসে মিলাদ-কিয়াম, বিশেষ ফাতিহা পড়া, বার্ষিক ওরস ইত্যাদি।
কবর জিয়ারতের সময় মাজারে চাদর দেয়া, ধূপ দেয়া এবং তাকে ধর্মীয় ত্বরিকারূপে দেখা।
নবী বা অলিয়ার কাছে সাহায্য চাওয়া বা তাদেরকে গায়েব (অদৃশ্য) থেকে হাযির ও নাযির মনে করা এগুলি শুধু বিদআতই নয়, বরং শিরক পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
এগুলোই “من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد” হাদীসের অন্তর্ভুক্ত। যার অর্থ:
"যে আমাদের এই দীন সম্পর্কে এমন কিছু নতুন করে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।"
নবম হিজরী শতকের অন্যতম খ্যাতিমান আলিম ও গবেষক, ইমাম আবু ইসহাক ইব্রাহীম শাতিবী (রহ.) তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ “আল-ই‘তিসাম”-এ বিদআতের বিষয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর গবেষণামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি সেখানে বিদআতের প্রচলিত সংজ্ঞা এবং তাকে 'হাসানা' (ভালো) ও 'সাইয়্যাহ' (মন্দ) এ দুই ভাগে বিভক্ত করার মতবাদকে মজবুত দলীলের মাধ্যমে খণ্ডন করেছেন। এই পূর্ণাঙ্গ ও বিশাল কিতাবের মূল প্রতিপাদ্যই হলো বিদআত বিষয়ে বিশ্লেষণ।
এদেশের মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও সংস্কারক, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-ও তাঁর অসংখ্য লেখায় এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, যেসব আলেম বিদআতকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন (হাসানা ও সাইয়্যাহ) তারা এক গভীর জ্ঞানগত ভুলে পড়েছেন। তাঁর মতে, 'বিদআতে হাসানা' নামে কিছুই নেই; বরং প্রত্যেক বিদআতই হলো নিকৃষ্ট এবং গোমরাহী।
তিনি আরও বলেন, যদি কেউ কোনো বিদআতে কোনো ধরনের নূরানিয়াত বা আধ্যাত্মিক আলো অনুভব করে, তবে সেটা তার অনুভূতি ও উপলব্ধির ভুল। কেননা, বিদআতে প্রকৃত কোনো আলো নেই তা শুধুই অন্ধকার ও বিভ্রান্তি।
এছাড়াও, সাহিহ মুসলিম-এর বিখ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ “ফাতহুল মুলহিম”-এ মাওলানা শব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)-ও এই বিষয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এটি জ্ঞানপিপাসু ও আলেম সমাজের জন্য পাঠযোগ্য ও উপকারপ্রদ একটি মৌলিক আলোচনা। (মা'আরিফুল হাদীস , হাদীস নং: ১৮৯০)
বিদআত থেকে বাঁচা কেন জরুরী??
১. বিদআতের প্রভাব:
সুন্নতের ফলাফল হেদায়াত, যা আল্লাহ তা’আলা ও তার রাসূলের সন্তুষ্টির কারণ। আর বিদআতের পরিণতি গোমরাহী, যা শয়তান ও নফসকে খুশি করে। সুন্নত পালনে রূহানী শক্তি বাড়ে, দিল তাজা হয়, আখিরাতের চিন্তা জাগে। বিপরীতে, বিদআত পালন নফসকে তৃপ্ত করে, আমলের জযবা কমায় এবং দুনিয়ার মোহ বাড়ায়।
قُلۡ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَاَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ ۚ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَاِنَّمَا عَلَیۡہِ مَا حُمِّلَ وَعَلَیۡکُمۡ مَّا حُمِّلۡتُمۡ ؕ وَاِنۡ تُطِیۡعُوۡہُ تَہۡتَدُوۡا ؕ وَمَا عَلَی الرَّسُوۡلِ اِلَّا الۡبَلٰغُ الۡمُبِیۡنُ
(তাদেরকে) বলে দাও, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের। তথাপি যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে রাখ, তবে রাসূলের দায় ততটুকুই, যতটুকুর দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা হয়েছে। আর তোমাদের উপর যে ভার অর্পিত হয়েছে, তার দায় তোমাদেরই উপর। তোমরা তাঁর আনুগত্য করলে হেদায়াত পেয়ে যাবে। রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল পরিষ্কারভাবে পৌঁছে দেওয়া। (সূরা নূর, আয়াত ৫৪)
وَعَن أنس رَضِي الله عَنهُ قَالَ قَالَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم من رغب عَن سنتي فَلَيْسَ مني
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন: যে আমার সুন্নাহ থেকে বিমুখ, সে আমার দলভুক্ত নয়। (আত্-তারগীব ওয়াত্-তারহীব, হাদীস নং: ৯১)
২. শয়তানের চক্রান্ত:
শয়তান বিদআতকে হাতিয়ার বানিয়ে নবীদের উপর প্রতিশোধ নেয়, বিশেষত শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর। তিনি শিরক ও কুফরকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছেন। তাই শয়তান তাঁর উম্মতকে বিদআতের পথে পরিচালনা করে প্রতিশোধ নেয়।
اِنَّ الشَّیۡطٰنَ لَکُمۡ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوۡہُ عَدُوًّا ؕ اِنَّمَا یَدۡعُوۡا حِزۡبَہٗ لِیَکُوۡنُوۡا مِنۡ اَصۡحٰبِ السَّعِیۡرِ ؕ
নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রুই গণ্য করো। সে তার অনুসারীদেরকে দাওয়াত দেয় কেবল এ জন্যই, যাতে তারা জাহান্নামবাসী হয়ে যায়। (সূরা ফাতির, আয়াত নং ৬)
৩. বিদআতের ভয়াবহতা:
শয়তান সাধারণ গুনাহের চেয়ে বিদআতকে বেশি প্রিয় মনে করে। কারণ, গুনাহ থেকে মানুষ তওবা করতে পারে, কিন্তু বিদআতের ক্ষেত্রে মানুষ তা ‘নেক কাজ’ মনে করে তওবার প্রয়োজনই অনুভব করে না। এভাবেই বিদআত মানুষকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে।
فَلَوۡلَاۤ اِذۡ جَآءَہُمۡ بَاۡسُنَا تَضَرَّعُوۡا وَلٰکِنۡ قَسَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَزَیَّنَ لَہُمُ الشَّیۡطٰنُ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
অতঃপর যখন তাদের কাছে আমার (পক্ষ হতে) সংকট আসল, তখন তারা কেন অনুনয়-বিনয় করল না? বরং তাদের অন্তর আরও কঠিন হয়ে গেল এবং তারা যা করছিল, শয়তান তাকে তাদের কাছে শোভনীয় করে দিল। (সূরা আনআ’ম. আয়াত ৪৩)
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ وَعَلاَ صَوْتُهُ وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ يَقُولُ " صَبَّحَكُمْ وَمَسَّاكُمْ " . وَيَقُولُ " بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَاتَيْنِ " . وَيَقْرُنُ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى وَيَقُولُ " أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ " . ثُمَّ يَقُولُ " أَنَا أَوْلَى بِكُلِّ مُؤْمِنٍ مِنْ نَفْسِهِ مَنْ تَرَكَ مَالاً فَلأَهْلِهِ وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضَيَاعًا فَإِلَىَّ وَعَلَىَّ " .
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন খুতবা দিতেন তখন তার চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ হত, স্বর উঁচু হত এবং কঠোর রাগ প্রকাশ পেত। মনে হত তিনি যেন আক্রমণকারী বাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, বলছেন, তারা তোমাদের সকালে আক্রমণ করবে এবং বিকেলে আক্রমণ করবে। তিনি বলতেন, আমি প্রেরিত হয়েছি এমন অবস্থায় যে, আমি ও কিয়ামত এ দুটির ন্যায় এবং মধ্যম অঙ্গুলী ও শাহাদাত অঙ্গুলী মিলিয়ে দেখাতেন। বলতেন, উত্তম বাণী হল আল্লাহ তাআলার কিতাব এবং সর্বোত্তম হিদায়াত হল মুহাম্মাদ (ﷺ) এর হিদায়াত। নিকৃষ্ট বিষয় হলো বিদআত (দ্বীনে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ।) সকল বিদআতই হল পথভ্রষ্টতা। এরপর বলতেন, আমি প্রত্যেক মুমিনের জন্য তার প্রাণ হতে অধিক প্রিয়তর। যে মৃত ব্যক্তি মাল সম্পদ রেখে যায়, তা তার পরিবার পরিজনদের জন্য। আর যে মৃতব্যক্তি ঝণ অথবা ছোট ছেলেমেয়ে রেখে যায়, তাদের দায়িত্ব আমার উপর। (সহীহ মুসলিম, আন্তর্জাতিক নং: ৮৬৭)
৪. রাসূল ﷺ এর সতর্কতা:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বিদায় হজ্বে বলেন, শয়তান তোমাদের মধ্যে মূর্তিপূজা ফিরিয়ে আনতে নিরাশ, কিন্তু ছোট ছোট কাজকে গুরুত্বহীন মনে করে মানুষ বিদআতে জড়িয়ে পড়ে। তাই সুন্নত ও কুরআনের পথেই থাকতে হবে।
ইরবাদ ইবন সারিয়াহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা আমার সুন্নত এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদ্বীনের সুন্নত অনুসরণ করবে। সুদৃঢ়ভাবে তা ধারণ করবে এবং দাঁত দিয়ে তা কামড়ে ধরে থাকবে। (ফিকহুস সুনান, হাদীস নং: ৭)
৫. সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি:
সাহাবীগণ বিদআতকে অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ বলে মনে করতেন। হযরত ইবনে উমর ও ইবনে মাসউদ (রা.) বিদআতকে কুফরের মতো মারাত্মক কাজ বলে অভিহিত করেছেন।
عن عبد الله بن عمر - رضي الله عنه -، قال: "كل بدعة ضلالة، وإن رآها الناسُ حسنَةَ".
ইবনে উমর (রা.) বলেন: “প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী, যদিও লোকেরা তা ভালো মনে করে।” বায়হাকি, “আল-মাদখাল” (হাদীস নং: ১৯১)
قال عبدُ اللهِ بنُ مسعودٍ : اتَّبِعوا ولا تبتدِعوا، فقد كُفِيتُم، وكلُّ بدعةٍ ضلالةٌ
ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন: “তোমরা আমাদের অনুসরণ করো, নতুন কিছু সৃষ্টি করো না; কারণ তোমরা ইতোমধ্যে সঠিক পথ পেয়ে গেছ।”
তাবরানী (হাদীস নং: ৮৭৭০) — [আল-মু‘জামুল কবীর লি তাবরানী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৫৪]
৬. বিদআতের পরিণতি:
বিদআত হল শিরকের পূর্বপ্রস্তুতি, সুন্নতের ধ্বংসকারী এবং শরীয়তের গোপন বিকৃতি। এটি আল্লাহর নিকট অন্যতম নিকৃষ্ট কাজ। কারণ এটি দ্বীনের মূল কাঠামোকেই বিনষ্ট করে।
اَمۡ لَہُمۡ شُرَکٰٓؤُا شَرَعُوۡا لَہُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا لَمۡ یَاۡذَنۡۢ بِہِ اللّٰہُ ؕ وَلَوۡلَا کَلِمَۃُ الۡفَصۡلِ لَقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ ؕ وَاِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ
তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) কি এমন শরীক আছে, যারা তাদের জন্য এমন দীন স্থির করে দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (আল্লাহর পক্ষ হতে) যদি মীমাংসাকর বাণী স্থিরীকৃত না থাকত তবে তাদের ব্যাপারটা চুকিয়েই দেওয়া হত। অবশ্যই জালেমদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। সূরা শূরা, আয়াত নং ২১
عَنْ عَائِشَةَ، رضى الله عنها قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ " . قَالَ ابْنُ عِيسَى قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم " مَنْ صَنَعَ أَمْرًا عَلَى غَيْرِ أَمْرِنَا فَهُوَ رَدٌّ " .
আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর সংযোজন করবে, যা এতে নেই তা পরিত্যাজ্য। রাবী ঈসা (রাহঃ) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ আমরা যা করিনি, যদি এমন কাজ কেউ করে, তাবে তা পরিত্যাজ্য। (সুনানে আবু দাউদ, আন্তর্জাতিক নং: ৪৬০৬)
নব আবিস্কৃত হলেই কি তা বিদআত হবে?
উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনা জানার পর বিদআতের বিষয়টি আশাকরি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যে কোনো নতুন উদ্ভাবন বা বিষয়/ কাজকে বিদআত গণ্য করতে হলে নিম্নের তিনটি শর্ত একসাথে পূরণ হতে হবে:১. সম্পূর্ণ নতুন বিষয় হতে হবে
যা রাসূল ﷺ ও সাহাবাদের যুগে একেবারেই অস্তিত্বহীন ছিল, এমন কিছু।
২. দ্বীনের অংশ মনে করা হতে হবে
সেই নতুন কাজটি ইবাদত, সওয়াব, সুন্নাত বা শরিয়তের অংশ মনে করে করা হবে।
৩. দ্বীনের ভেতরে সংযোজনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে
অর্থাৎ নতুন কাজটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হবে, যেন তা দ্বীনের কোনো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত বা মুস্তাহাব কাজের অংশ।
আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে ঈমান নষ্টকারী শিরক ও আমল নষ্টকারী বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুক। আমীন
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধিঃ বহু কবীরা গোনাহের সমষ্টি
...
চারদিনা-চল্লিশা শরয়ী বিধান
...
নাজাতের জন্য শিরকমুক্ত ঈমান ও বিদ'আতমুক্ত আমল জরুরী
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد فأعوذ بالله من الشي...
সুন্নাতে খাতনা : করণীয়-বর্জনীয়
একটি হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয় ইসলামের স্বভাবজাত বৈ...